ইউরোপের ক্লাব ফুটবল মৌসুম শেষ হয়েছে প্রায় দুই সপ্তাহ আগে। তবে বিশ্বজুড়ে ফুটবলপ্রেমীরা নতুন মৌসুমের জন্য দু’মাস অপেক্ষায় থাকছেন না। ফুটবল অনুরাগীদের উন্মাদনা ধরে রাখতে ফিফা চালু করতে যাচ্ছে নতুন ক্লাব বিশ্বকাপ, শুরু ২০২৫ সালের ১৫ জুন, যুক্তরাষ্ট্রে। তবে উদ্বোধনের আগেই টুর্নামেন্টটি ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা সংশয়, অনীহা ও সমালোচনার পরিবেশ।
৩২টি শীর্ষ ক্লাব নিয়ে এক মাসব্যাপী এই প্রতিযোগিতাকে ফিফা বলছে “ক্লাব ফুটবলের শিখরে পৌঁছানো” উদ্যোগ। চ্যাম্পিয়ন দল পাবে ১২৫ মিলিয়ন ডলার, এবং পুরো টুর্নামেন্টের জন্য নির্ধারিত হয়েছে ১ বিলিয়নেরও বেশি অর্থ পুরস্কার। এই বিপুল অর্থায়নের মূল পৃষ্ঠপোষক সৌদি আরব, যারা এর বিনিময়ে ২০৩৪ সালের বিশ্বকাপ আয়োজনের অধিকার নিশ্চিত করেছে। এসবের সঙ্গে উঠে আসছে পুরোনো অভিযোগ—স্বার্থসংশ্লিষ্ট লেনদেন ও ফিফার স্বচ্ছতার ঘাটতি। হতাশাজনক টিকিট বিক্রি ও কমে যাওয়া দর্শক আগ্রহ। উদ্বোধনী ম্যাচে অংশ নিচ্ছে মেসির ইন্টার মায়ামি ও মিশরের আল আহলি। খেলা হবে হার্ড রক স্টেডিয়ামে, যার ধারণক্ষমতা ৬৫ হাজার। কিন্তু উদ্বোধনের মাত্র এক সপ্তাহ আগে পর্যন্তও বিক্রি হয়েছে টিকিটের এক-তৃতীয়াংশ। দর্শক টানতে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে টিকিটের দামও। এমনকি মেসির উপস্থিতিও দর্শকদের তেমন আগ্রহী করতে পারছে না, যা টুর্নামেন্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
আরও সমস্যার যোগ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা শাসনামলে জারি হওয়া নতুন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, যার ফলে ১৯টি দেশের নাগরিকরা দেশটিতে প্রবেশ করতে পারছেন না। এতে করে আন্তর্জাতিক দর্শকদের অংশগ্রহণের সম্ভাবনাও অনেকটা কমে গেছে। ফিফা বনাম ইউরোপীয় আধিপত্য। অনেকের মতে, এই টুর্নামেন্ট মূলত ফিফা ও ইউরোপীয় ফুটবল সংস্থা উয়েফার মধ্যকার এক ধরনের প্রভাব বিস্তারের লড়াই। চ্যাম্পিয়নস লিগকে বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ মর্যাদার ক্লাব প্রতিযোগিতা ধরা হয়। ইউরোপীয় ক্লাবগুলো শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, খেলোয়াড় সম্পদেও শ্রেষ্ঠ। ফিফা এই আধিপত্যের অংশীদার হতে চায়।
তবে বাস্তবতা বলছে, ইউরোপ ছাড়া ট্রান্সফারমার্কেটের শীর্ষ ৫০ ক্লাবের মধ্যে মাত্র একটি ক্লাবই—ব্রাজিলের পালমেইরাস—এই তালিকায় আছে। ফলে তারকা সমৃদ্ধ দল গঠন বা দর্শক আকর্ষণে ইউরোপের বাইরে থাকা ক্লাবগুলো অনেকটাই পিছিয়ে। ইতিহাস বলছে, এমন উদ্যোগ বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে। একটি বৈশ্বিক ক্লাব প্রতিযোগিতা চালুর প্রচেষ্টা চলছে ১৯৬০ সাল থেকে। ২০০০ সালে ফিফা প্রথম ক্লাব বিশ্বকাপ আয়োজন করলেও দর্শকহীনতার কারণে ২০০১ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত টুর্নামেন্ট স্থগিত ছিল। ২০০৫ থেকে ফের চালু হলেও ইউরোপীয় ক্লাবগুলোর একচেটিয়া দাপট বজায় থেকেছে; করিন্থিয়ানস ছাড়া ২০১২ সালের পর কোনো নন-ইউরোপীয় ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি।
এই নতুন সংস্করণে দল বাড়িয়ে ৩২টি করা হয়েছে এবং সময় ঠিক করা হয়েছে ইউরোপীয় মৌসুম শেষ হওয়ার গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে। কিন্তু এ সময় খেলোয়াড় ও সমর্থকরা মানসিকভাবে বিশ্রামে থাকেন, যা টুর্নামেন্টে আগ্রহে ঘাটতি ফেলেছে। ফিফার দাবি, এই আয়োজনে তাদের নিজস্ব কোনো লাভ নেই; আয়কৃত অর্থ সম্পূর্ণভাবে ক্লাবগুলোর মাঝে বণ্টন করা হবে। কিন্তু তবুও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—ব্যস্ত ক্রীড়া সূচিতে এমন একটি নতুন টুর্নামেন্ট আদৌ প্রয়োজন ছিল কি?
বিশ্লেষকদের মতে, এটি আরেকটি ব্যর্থ উদ্যোগের পুনরাবৃত্তি, যা ইউরোপীয় ক্লাবগুলোর আধিপত্য আরও মজবুত করবে—বিশ্ব ফুটবলের সমন্বয় নয়, বরং বৈষম্যই বাড়াবে। ফলে, ক্লাব বিশ্বকাপ সত্যিই কি গ্লোবাল ফুটবলের এক মহোৎসব, নাকি কেবলই এক অহংকারের প্রতিফলন? হয়তো এর উত্তর মিলবে শূন্য গ্যালারি আর নীরব রাতেই।