গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অন্যতম অগ্রণী মুখ ছিলেন উমামা ফাতেমা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তবে এবার নানা অভিযোগ তুলে সংগঠনটি থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
শুক্রবার (২৭ জুন) রাতে ফেসবুকে দেওয়া একটি পোস্টে উমামা জানান, তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। তিনি লেখেন, “গত পরশু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হয়েছে। সেখান থেকেই আমার এই প্ল্যাটফর্মে আনুষ্ঠানিক যাত্রার ইতি টানলাম।” সরে দাঁড়ানোর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উমামা বলেন, “এনসিপি গঠনের পর আমি জুলাইয়ের অসমাপ্ত কাজের দায়বদ্ধতা থেকে এই ব্যানারে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই। তবে ব্যানারটি স্বাধীনভাবে চালালে তা অনেকের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াত। এ কারণে আমাকে ভয়াবহ চাপের মুখে পড়তে হয়—অনলাইন এবং অফলাইন—যাতে আমি কাজ না করি। তবুও আমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিষয়টি নিয়ে ব্যানার সচল রাখতে চেয়েছিলাম। পরে যা ঘটেছে, তা আলাদাভাবে বলার কিছু নেই।”
তিনি আরও জানান, “যাদের সঙ্গে একসাথে মিছিল-মিটিং করেছি, তারাই পরিকল্পিতভাবে জুনিয়রদের দিয়ে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে। মুখে যতই ভালো হোক না কেন, ভিতরে ভিতরে কতটা ক্ষুদ্র হতে পারে, তা আমি সেই সময় অনুভব করেছি। এই তথাকথিত সহযোদ্ধারাই প্রয়োজন শেষে মানুষকে ছুড়ে ফেলে দিতে এক মুহূর্তও ভাবে না। মার্চ-এপ্রিলে যখন কাজ করতে যাই, তখন দেখি প্ল্যাটফর্মটি সুবিধাবাদীদের হাতে ধ্বংস হয়ে গেছে।” তবে উমামা স্বীকার করেন, “বিভিন্ন শাখা কমিটিতে অনেক সৎ এবং আন্তরিক মানুষ ছিলেন, যারা পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে কাজ করতে এসেছিলেন। কিন্তু তারাও সুবিধাবাদীদের কাছে ঠাঁই পাননি।” তিনি জানান, “আমি বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্মে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, যাদের কাছে প্ল্যাটফর্মের দায়িত্ব থাকা উচিত, তারা বরং আমাকে বাদ দিয়ে অপপ্রচারে ব্যস্ত ছিল। পেইজ অ্যাক্সেস না দিয়েই আমার বিরুদ্ধে পোস্ট দেওয়া হয়েছে। আমি ব্যবস্থা নিতে গেলেই সেই পেইজকেই আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। দিনের পর দিন অপমান, নিগ্রহ, নোংরামি চলেছে। এই অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে গিয়ে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম।” তিনি আরও বলেন, “একদিকে কেউ কেউ সামনে এসে আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করত, আবার রাতের বেলা হেয়ার রোডে গিয়ে পদ-পদবী নিয়ে দরকষাকষি করত। আমাকেও বলা হতো, যেন আমি গিয়ে ‘সুপ্রিম অথরিটির’ কাছে পদ চাই। আমি জিজ্ঞেস করেছি—ওরা কারা যে আমাকে পদ দেবে? যদি তাদের কাছে পদ চাইতেই হয়, তাহলে এই প্ল্যাটফর্মের স্বাতন্ত্র্য কোথায়?”
উমামা অভিযোগ করেন, “এই প্ল্যাটফর্ম কার্যত ভাই-ব্রাদার রাজনীতির জালে আটকে আছে। আমি কাজ করতে গেলেই বাধা দেওয়া হতো। বরং বলা হতো আমি কাউকে কাজ করতে দিচ্ছি না, কাউন্সিল আটকে রেখেছি। নেতারা নিজস্ব জুনিয়রদের দিয়ে প্রোপাগান্ডা ছড়াত। এসব দেখে আমি সিদ্ধান্ত নিই, আর নয়। আমি মুখপাত্র পরিচয় ছেড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীর পরিচয় বেছে নিই।” তিনি বলেন, “আমি বৈষম্যবিরোধী কাউন্সিলে ভোট না দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। তবে শেষ মুহূর্তে, নির্বাচন শেষ হওয়ার এক মিনিট আগে ভোট দিই, কারণ কিছু ভালো প্রার্থী ছিল যাদের কাজের প্রতি আন্তরিকতা ছিল। কিন্তু নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর দেখি, নির্বাচনে অংশ না নেওয়া একজনও কাউন্সিল সদস্য হয়ে গেছে। এতে আমি অত্যন্ত হতাশ ও বিব্রত হই।” সবশেষে উমামা লেখেন, “অভ্যুত্থানের কথা ভেবে আমি এই প্ল্যাটফর্মে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে এসে দেখি মুখে শুধু শহীদ, আহত, সংস্কারের কথা বলা হলেও বাস্তবে এগুলো ছিল রাজনৈতিক ছলনা মাত্র। যারা স্বার্থসিদ্ধির জন্য অভ্যুত্থানকে ব্যবহার করেছে, আমার সঙ্গে নোংরামি করেছে, আমি কখনোই তাদের ক্ষমা করব না। তাদের জন্য আমার অন্তরের গভীর থেকে বদদোয়া রইল।”
“আমি চাই অতীত ঝেড়ে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে। এখন পড়াশোনা ও বাস্তব জীবনের কাজেই মনোযোগ দিতে হবে। অনেক ভালো মানুষ আছেন, যারা এখনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, তাদের প্রতি আমার শুভকামনা। আমিও থেমে যাচ্ছি না, নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছি। ফি আমানিল্লাহ।”