বিতর্ক শুধু মত প্রকাশের মাধ্যম নয়, এটি জ্ঞান ও যুক্তি চর্চার এক অনন্য মঞ্চ। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে (খুবি) একমাত্র বিতর্ক সংগঠন ‘নৈয়ায়িক’ এই মঞ্চকে আলোকিত রেখে ২০০১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করে। নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে সম্প্রতি এটি ২৫ বছরে পা রেখেছে। এটি কেবল একটি সংগঠনের পথচলা নয়, বরং এক স্বপ্ন ও সম্ভাবনার গল্প। নৈয়ায়িক প্রতিষ্ঠার পর থেকে সাহস, দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে বিতর্কচর্চা চালিয়ে যাচ্ছে কিছু উদ্যমী তরুণ। সংগঠনটি প্রতি বছর বিভিন্ন ধরনের বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে, যার মধ্যে রয়েছে ফ্রেশারস লীগ, আন্তঃডিসিপ্লিন এবং আন্তঃহল বিতর্ক প্রতিযোগিতা। এসব আয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্ক মজবুত করে এবং ক্যাম্পাসে মুক্ত চিন্তার পরিবেশ সৃষ্টি করে। শুধু ক্যাম্পাসে সীমাবদ্ধ না থেকে, নৈয়ায়িক আয়োজন করে ‘নৈয়ায়িক ন্যাশনালস’, যা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা বিতার্কিকদের অংশগ্রহণে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। এই বছর দেশের ১৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্বনামধন্য সরকারি কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থীরা। ২০২৫ সালে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো হলো-বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি ব্রজলাল কলেজ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ।
শুক্রবার বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু একাডেমিক ভবনের চতুর্থ তলায় দেখা যায়, প্রতিটি কক্ষে বিতার্কিকদের মিলন মেলা বসেছে। চূড়ান্ত পর্বের জন্য অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা গ্রুপে ভাগ হয়ে বাছাই পর্বে অংশ নিচ্ছে। খুবির নৈয়ায়িকের সদস্যরা শুধু আয়োজক নয়, দেশের বিভিন্ন জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতাতেও নিয়মিত অংশগ্রহণ করে। তাদের অর্জনের ঝুলিতে রয়েছে ডজনখানেক জাতীয় ট্রফি, যা তাদের দক্ষতা ও নিষ্ঠার প্রমাণ। সংগঠনটি বর্তমানে ৩৩ সদস্যবিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। সভাপতি হিজবুল্লাহ তামিম ও সাধারণ সম্পাদক খালিদ আহমেদের নেতৃত্বে নৈয়ায়িক নিয়মিত সাপ্তাহিক সেশন আয়োজন করে। প্রতি রোববার ইংরেজি এবং বুধবার বাংলা বিতর্কের মাধ্যমে তারা নিজেদের যুক্তি-চর্চা করে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক খালিদ আহমেদ বলেন, ‘নৈয়ায়িক কেবল একটি সংগঠন নয়, এটি আমাদের জন্য ‘আরেকটি পরিবার’। আমাদের নিজস্ব কার্যালয় নেই এবং আনুষঙ্গিক সরঞ্জামও সীমিত। আশা করছি দ্রুত এই সমস্যা সমাধান হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখানকার শিক্ষার্থীরা বিতর্কের মাধ্যমে সামাজিকতা, মানবিকতা এবং সাংগঠনিক দক্ষতা অর্জন করে। নিজেদেরকে উপস্থাপন করার কৌশলও এখানেই শেখে তারা।’
নৈয়ায়িক যেন একদল বিতার্কিকের বাসভূমি। খুবিতে বিতর্ক চর্চা বললেই এই সংগঠনের নাম উচ্চারিত হয়। সদস্যরা শুধুমাত্র নিজেদের ক্যাম্পাসে সীমাবদ্ধ থাকেন না, খুলনার অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বিতর্কের আলো ছড়িয়ে দেন। প্রতি বুধবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে তারা মিলিত হন এবং তরুণ বিতার্কিকদের নিয়ে নিয়মিত বিতর্কচর্চা করেন। সভাপতি হিজবুল্লাহ তামিম বলেন, ‘বিতর্ক মানুষের বুদ্ধি জাগ্রত করে। এই লক্ষ্য সামনে রেখে নৈয়ায়িকের কাজ ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। আমরা আমাদের কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করার চেষ্টা চালাব।’ নৈয়ায়িক নেতৃত্ব, বুদ্ধিমত্তা এবং প্রগতির প্রতীক। এটি কেবল একটি বিতর্ক সংগঠন নয়, এটি চিন্তার স্কুল, নেতৃত্বের আঁতুড়ঘর এবং যুক্তির আলোয় আলোকিত মঞ্চ। এখান থেকে উঠে আসা প্রতিটি বিতার্কিক যুক্তি-বোধ, বিশ্লেষণ ক্ষমতা ও মানবিক মূল্যবোধে গড়ে ওঠে একজন সচেতন নাগরিক। ভবিষ্যতেও নৈয়ায়িক যেন যুক্তির বাতিঘর হয়ে আলো ছড়িয়ে দেয়-এই প্রত্যাশা রয়েছে সকল সদস্যদের।